Bangla Runner

ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪ | বাংলা

শিরোনাম

গ্রীষ্ম, বর্ষা না বসন্ত কোন ঋতু সেরা?  এফ রহমান ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি শাখাওয়াত, সম্পাদক আশিক বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠানোর ই-মেইল বিশ্বের সবচেয়ে দামি ৫ মসলা Important Quotations from Different Disciplines স্যার এ এফ রহমান: এক মহান শিক্ষকের গল্প ছয় সন্তানকে উচ্চ শিক্ষত করে সফল জননী নাজমা খানম ‘সুলতানার স্বপ্ন’ সাহিত্যকর্মটি কি নারীবাদী রচনা? কম্পিউটারের কিছু শর্টকাট ভালো চাইলে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াতে শুরু করুন
Home / বই আলোচনা

ঢাবির প্রথম উপাচার্য হার্টগ বুঝেছিলেন বাঙালি সমাজে তদবির কী জিনিস!

এম.এস.আই খান
শনিবার, ২১ আগস্ট, ২০২১ Print


36K

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে যোগ দেয়ার পর ফিলিপ হার্টগ বেশ বিপাকে পড়ে যান! বাঙালি সমাজে চাকরি-বাকরির ব্যাপারে তদবির কী জিনিস, তা টের পান তিনি। ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের হিন্দু শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেতে দৌঁড়-ঝাপ শুরু করেন। তাদের পক্ষে স্থানীয় হিন্দু জমিদাররা তদবিরে নামেন। তারা হার্টগের সাথে কথা বলার জন্য, একটি সুযোগ খুঁজছিলেন। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে হার্টগ তাদের সময় দিচ্ছিলেন না। অর্থাৎ এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। 

কোন ভাবেই সুযোগ না পেয়ে কার্যোদ্ধারে নতুন কৌশল হাতে নেয় তারা। ঢাকার বলধা গার্ডেনের জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের বাসায় নতুন উপাচার্যকে সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করে বসে! আর মনে মনে ঠিক করা হয় ওই অনুষ্ঠানে ঢাকা ও জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপকদের বিষয়ে উপাচার্যকে বলা হবে! কিন্তু সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হার্টগ বলে আসেন, ‌‌‌‌‌''আপনাদের দাবি বিবেচনা করা হবে। তবে আপনারা নিশ্চয়ই বোঝেন, এই মুহূর্তে কাউকে আশ্বাস দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।''

হার্টগকে নানাভাবে তোষামোদ ও প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়েছে, ক্ষমা প্রার্থনা করে তিনি অনড় ছিলেন। নিয়োগের ব্যাপারে যারা চাপ দেন তারা ছিলেন ঢাকার খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সে চাপ উপেক্ষা করেন। ঢাকার নবাব পরিবার থেকেও দু-চারজন মুসলমানকে নিয়োগ দেওয়ার অনুরোধ আসে। হার্টগ জানিয়ে দেন, যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া তিনি কাউকে নিতে পারেন না। পরে আর তদবিরের জন্য কোন পক্ষই তার কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি। ফিলিপ হার্টগ হিন্দু বা মুসলমান ছিলেন না। শাসকদের ধর্মানুসারী অর্থাৎ খ্রিষ্টানও নন। তিনি নিজে ইহুদি হওয়ায় কোন পক্ষের প্রতি তার বিশেষ পক্ষপাতের প্রয়োজন হয়নি।

১৮৬৪ সালের ২ মার্চ ফিলিপ লন্ডনে অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ স্কুল, ফ্রান্সের কলেজ দ্য ফ্রান্স ও দ্য ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস এবং জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। কর্মজীবন শুরু করেন ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে রসায়নের সহকারী প্রভাষক হিসেবে। ব্রিটেনের বেশ কয়েকজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত রসায়নবিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু। তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ বছর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ১৭ বছর তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্টার ছিলেন। 

তার ৬০ বছরের কর্মজীবনের মধ্যে তিনি মাত্র পাঁচ বছর কাটিয়েছেন ঢাকায়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাঁচটি বছর ফিলিপ দিনে অন্তত ১৮ ঘণ্টা কাজ করতেন বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে। ১৯২০ সালের ২১ জুন এক চিঠিতে ফিলিপকে জানানো হয়, উপাচার্য হিসেবে তার মাসিক বেতন চার হাজার টাকা এবং বাসভবন হবে ফ্রি। তার জন্য বরাদ্দ বাসভবনটি ছিল ঢাকার নবাববাড়ির পরই সবচেয়ে সুরম্য অট্টালিকা (বর্তমান উপাচার্যের বাসভবন)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই যখন যাত্রা শুরু করে তখন এই বঙ্গে অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনে সমগ্র বাংলাদেশ খুবই উত্তপ্ত। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এমনি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে হার্টগ এক স্বপ্নের ভেলা ভাসান।

হার্টগের স্ত্রী লেডি ম্যাবেলের কাছ থেকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‌অনেক পেয়েছে। (১৯১৫ সালে হার্টগ ও লেডি ম্যাবেলের বিয়ে হয়।) আজন্ম লন্ডনের মানুষ লেডি ম্যাবেল ৩৪ বছর বয়সে বলতে গেলে প্রাণহীন শহর ঢাকায় আসেন। লন্ডনের সঙ্গে কোন দিক দিয়েই ঢাকার তুলনা হয় না! ইহুদি পরিবার ঢাকায় নেই বললেই চলে। এমন একটি আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশে এসে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিকের ছেলেসর্বস্ব ক্লাশে কোন মেয়ের পক্ষে ক্লাশ করা সেকালের সামাজিক অবস্থায় সম্ভব ছিল না। পাঁচ বছর লেডি ম্যাবেল নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গ দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে ক্লাশে যেয়ে এক কোণে বসে থাকতেন। বাসায়ও নিয়ে যেতেন ছাত্রীদের। বলতে গেলে বিনা বেতনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজ করেছেন ম্যাবেল। কারণ বেতন পেত স্বামী একা আর কাজ করতেন দু’জনেই।

অনেক ইংরেজই তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে রিভলবার বা পিস্তল রাখতেন। হার্টগেরও একটি রিভলবার ছিল। সেটা কেউ কখনো দেখেনি বা তার একটি গুলিও খরচের প্রয়োজন হয়নি। উপাচার্য ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষকদের পাঠদান সম্পর্কে জানতেন। আর গ্রন্থাগার থেকে রেজিস্ট্রি খাতা আনিয়ে দেখতেন কত ছাত্র বই ধার নিয়েছে! ইংরেজি জানে না এমন মানুষদের সঙ্গে তিনি ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতেন। জানা গেছে, প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের সঙ্গে তিনি কুশল বিনিময় করতেন বাংলায়!

শিক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ‌'নাইট' উপাধি পান। পাঁচ বছর এক মাস দায়িত্ব পালন করে ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগের পূর্বে অন্য সবার পাওনা পরিশোধ করে গেলেও স্টেটসম্যান পত্রিকার ৫টাকা ৪ আনা বকেয়া রয়ে গিয়েছিল। লন্ডন যাবার পর তিনি সেই টাকা পরবর্তী উপাচার্য ল্যাংলির কাছে পাঠিয়ে দেন স্থানীয় এজেন্টকে বুজিয়ে দিতে। যা ছিল তার নিয়মানুবর্তিতা ও কর্তব্যপরায়ণতার একটি দৃষ্টান্ত।

ঢাকা ত্যাগের পরেও তিনি নানাভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজ-খবর রাখতেন। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক যারাই লন্ডনে গেছেন, তিনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা জানতে চেয়েছেন। 

১৯৪৭ সালের ২৭ জুন ফিলিপ হার্টগ লন্ডনের একটি নার্সিং হোমে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান। হার্টগের মৃত্যুর পরও লেডি ম্যাবেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভোলেননি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটনার পর তিনি এক চিঠিতে মাতৃভাষার অধিকার দাবি করা ছাত্রদের ওপর চালানো নির্মমতাকে 'গ্রেট ট্রাজেডি' বলে উল্লেখ করেন। ১৯৫৪ সালে এই লেডি ম্যাবেলও চলে যান না ফেরার দেশে। ইতালিতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হার্টগের সংসার ছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। হার্টগ দম্পতি তাদের দায়িত্ব ষোল আনা পালন করেছেন। কিন্তু যাদের কল্যাণে কাজ করেছেন তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। হার্টগকে মনে রাখেনি, একটি ছাত্রাবাস করেই নিজের দায় সেরেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সমালোচনা: তৃতীয় মুদ্রণ: মে ২০১৮ সংস্করণের বইটির ৩০ পৃষ্ঠার শেষ প্যারার বলা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ আরো কিছু কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেতে বিলম্ব ঘটে। তথ্যটি সঠিক নয়, এখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হবে। আর বইটির ৮৪ পৃষ্ঠায় জগন্নাথ হল সম্পর্কে বলা হয়েছে, “১৮৮৪ সালের অক্টোবরে সেই মিলনায়তনটি বিধ্বস্ত হয়ে ১০১ জন ছাত্র নিহত হয়।” এই তথ্যটিও সঠিক নয়। জগন্নাথ হলে দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে এবং তাতে ৩৯ জন মৃত্যুবরণ করেন। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে শুধরে নিবেন।

বই: স্যার ফিলিপ হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য, লেখক: সৈয়দ আবুল মকসুদ, (প্রথমা প্রকাশন, মুদ্রিত মূল্য: ২২০ টাকা, পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১১২)।

এ সম্পর্কিত আরো:

১. অন্ন জোটেনি,পায়ে ‍জুতা ছিল না সেই ছেলে হয়েছিলেন ঢাবির উপাচার্য

২. ‘ভিসি হওয়ার প্রস্তাব’ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

৩. ঢাবি ভিসি আখতারুজ্জামান: একজন ফুলব্রাইট স্কলারের গল্প

 

আরও পড়ুন আপনার মতামত লিখুন

© Copyright -Bangla Runner 2024 | All Right Reserved |

Design & Developed By Web Master Shawon