Bangla Runner

ঢাকা , শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪ | বাংলা

শিরোনাম

গ্রীষ্ম, বর্ষা না বসন্ত কোন ঋতু সেরা?  এফ রহমান ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি শাখাওয়াত, সম্পাদক আশিক বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠানোর ই-মেইল বিশ্বের সবচেয়ে দামি ৫ মসলা Important Quotations from Different Disciplines স্যার এ এফ রহমান: এক মহান শিক্ষকের গল্প ছয় সন্তানকে উচ্চ শিক্ষত করে সফল জননী নাজমা খানম ‘সুলতানার স্বপ্ন’ সাহিত্যকর্মটি কি নারীবাদী রচনা? কম্পিউটারের কিছু শর্টকাট ভালো চাইলে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াতে শুরু করুন
Home / বই আলোচনা

অন্ন জোটেনি,পায়ে ‍জুতা ছিল না সেই ছেলে হয়েছিলেন ঢাবির উপাচার্য

এম.এস.আই খান
শনিবার, ২১ আগস্ট, ২০২১ Print


34K

শহর হতে অনেক দূরে পূর্ব  বাংলার এক অল্প পরিচিত গ্রামে বিশ্ববরেণ্য এক ঐতিহাসিকের বাল্য ও শৈশব জীবন কেটেছে। তার পিতামহের ছয় ছেলেকে নিয়ে যৌথ পরিবার ছিল। ওই পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ত্রিশজনের মতো। তাদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। তাই দরিদ্রতার মাঝেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। এ বিষেয়ে তিনি নিজেই স্মৃতিচারণ করে লিখে গেছেন, “...কোন রকমে আমাদের সংসার চলত। দু-চারদিন অন্ন জোটেনি, এমন ঘটনাও মনে পড়ে, আমার পায়ে ‍জুতাও ছিল না। সে দিনগুলো ছিল খুবই দুঃখকষ্টের, আমাদের ঘর ছিল খড়ের। ঘরে মাটির মেঝে, বাঁশ ও হোগলার বেড়া ছিল।”

বলছিলাম ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চুতুর্থ উপাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদারের কথা। যার নামানুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের অধীনে লেকচার থিয়েটার ভবনে ‘আর সি মজুমদার অডিটরিয়াম’ নামকরণ করা হয়েছে। এই রমেশচন্দ্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর প্রথমে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, এরপর জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট এবং তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরূপে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন সমকালীন ঐতিহাসিকদের মধ্যে শীর্ষ স্থানীয়। 

১৮৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার খান্দারপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণের করেন তিনি। হলধর মজুমদার ও বিধুমুখী দেবীর তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে রমেশ ছিলেন সবার ছোট। পিতা হলধর মজুমদার আগরতলার ত্রিপুরা এস্টেটের রাজার উকিল হিসেবে কাজ করতেন। জীবনের স্মৃতিদীপ নামক নিজের আত্মজীবনী বইতে তিনি জানিয়েছেন, তার জন্ম বৈদ্যবংশে এবং বল্লালসেন বাংলায় যে কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন মজুমদারের বংশ সেই প্রথা অনুসারে কুলীন বলে পরিচিত ছিল। 

রমেশের বয়স যখন দেড় বছর তখন তার মা বিধুমুখী দেবী মারা যান। এরপর তিনি তার বড় চাচির (জ্যাঠিমা) কাছে লালিত-পালিত হন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি ইংরেজি মাইনর স্কুলে ভর্তি হন। বড় ভাই প্রকাশচন্দ্র মজুমদার একটি সরকারি ইংরেজি স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দিলে ১৯০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিন ভাই কলকাতায় চলে যান। সেখানে যেয়ে রমেশ সাউথ সুবাবার্ন স্কুলে ফিফ্থ ক্লাসে ভর্তি হন। এরপর জেনারেল এসেম্বলি স্কুলে থার্ড ক্লাসে ভর্তি হন।

১৯০২ সালে সতীশশচন্দ্র ও রমেশচন্দ্র দুই ভাই ঢাকায় এসে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন।  তারা প্রথমে তিন মাস ঢাকায় তাদের মায়ের মামা বাড়িতে এবং পরে ছাত্রবাসে চলে যান। এরপর হুগলির হলেজিয়েট স্কুল ঘুরে ১৯০৫ সালে কটকের র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল থেকে এনাট্রান্স পাশ করেন। এফএ পড়ার জন্য তিনি প্রথমে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে পড়াশোনা করেন এবং পরে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ পড়ার জন্য ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। বিএ পাশ করার পর এই কলেজ থেকেই ১৯১১ সালে তিনি এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হন।

এরপর তিনি আইন বিষয়ে পড়েন। এ বিষয়ে প্রথম পার্ট পাস করে কিছুদিন কলকাতার হাইকোর্টের আর্টিকল্ড ক্লার্ক হিসেবে কাজ করেন। ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা ট্রেনিং কলেজে প্রভিন্সিয়াল সার্ভিসে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সাত বছর এখানে অধ্যাপনা করার পর ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

মাত্র ৩৩ বছর বয়সে সংস্কৃত বিষয়ের হরপ্রসাদ শাস্ত্রীয়কে হারিয়ে তিনি ডিন নির্বাচিত হন। ১৯২৪ হতে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর তিনি জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন জগন্নাথ হলের দ্বিতীয় প্রভোস্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় এলে তিনি প্রাধ্যক্ষ রমেশচন্দ্রের বাসাতে অতিথি হিসেবে ছিলেন। বাসায় অবস্থান কালে রমেশচন্দ্রের মেয়ে সুষমা (ডাক নাম শান্তি) কবির সামনে যেয়ে বলেন, “আপনি নাকি খুব বড় কবি? আপনি নাকি অনেক কবিতা লিখেছেন।” রবীন্দ্রনাথ হাসিমুখে জবাব দেন, “হ্যাঁ, এই দুর্নাম আমার আছে”। অমনি একটা ছোট খাতা বের করে কবিকে বলে, “আমার নামে একটি কবিতা লিখে দেন”। রবীন্দ্রনাথ তখন লিখে দেন-


“আয়রে বসন্ত হেতা, কুসুমের সুষমা জাগারে
শান্তি স্নিগ্ধ মুকুলের হৃদয়ের নিস্তব্ধ আগারে।
ফলেরে আনিব ডেকে
সেই লিপি যাস্ রেখে,
সুবর্ণ তুলিকাখানি পর্ণে পর্ণে যতনে লাগারে।”
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২রা ফাল্গুন,১৩৩২।

রবীন্দ্রনাথ আসার ১০ বছর পর কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন এবং রমেশচন্দ্রের বাসাতে তিনিও অতিথি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে শরৎচন্দ্রকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। শরৎচন্দ্রের কোন বিশ্বদ্যিালয় ডিগ্রি না থাকায় এর আগে অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এ ধরণের সম্মান প্রদর্শন করেনি।
 
অন্যদিকে রমেশচন্দ্র মজুমদার যখন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ (প্রভোস্ট) ছিলেন তখন পূর্ব বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। ড. রমেশচন্দ্র পুলিশি হামলা ও গ্রেপ্তার থেকে ছাত্রদের রক্ষা করতে চেষ্টা করতেন। ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরও এই চেষ্টা অব্যাহত ছিল। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য জেলে আটক হলে রমেশচন্দ্র মজুমদার তাকে ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেন। হরেশচন্দ্র স্মৃতিচরাণ করে লিখেছেন, “একবার পুলিশ একটি ছাত্রকে গেপ্তার করিয়া হাঁটাইয়া থানায় নিয়া যাইতে উদ্যত হলে আচার্য পুলিশকে বলিলেন, “একে গাড়ী করিয়া নিয়া যাওয়া হোক, গাড়ী ভাড়া আমি দেব”।” নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসুর সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল এবং অর্থ সাহায্যও প্রদান করতেন বলে জানা যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কোর্ট ও এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থরক্ষার জন্য ঢাকার প্রভাবশালী হিন্দু সদস্যদের বিরোধীতা বলিষ্ঠতার সাথে মোকাবিলা করতেন। প্রয়োজনবোধে ঐসব সংস্থার মুসলমান সদস্যদের সঙ্গে একযোগে হিন্দু সদস্যদের বিরোধীতাকে নিরস্ত করতেন। ১৯৪২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। 

তিনি বাংলা ভাষায় একক প্রচেষ্টায় বাংলালাদেশের ইতিহাস (পাচীন ও আধুনিক যুগ) এবং নিজস্ব সম্পাদনায় বাংলাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ) রচনা করে  কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু গবেষণা কাজ করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। গবেষণা ও কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করেছে। 

এ ছাড়াও তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশিকোত্তম, নব নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদ্যাবারিধি, কলকাতা সংস্কৃত কলেজ থেকে ভারত তত্ত্ব ভাস্কর উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে রবীন্দ্র মেমোরিয়াল পুরস্কার প্রদান করেন। এই প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ ৯২ বছর বয়সে ১৯৮০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সমালোচনা: বইটিতে উপাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদারের সমালোচনা স্থান পায়নি। যদি সমালোচনাগুলো উপস্থাপন করে তার কারণ খোঁজা হত তবে বইটি আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেত। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ তুলে ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদারের অবদানকে যারা খাটো করতে চান তাদের জন্য কিছু জবাব লেখক এই বইতে হাজির করতে পারলে পাঠক আরো বেশি তৃপ্ত হত। আর পাঠক হিসেবে বইটি পড়ে উপাচার্য থাকাকালীন সময়ে তার অবদান বা সংস্কারগুলো সম্পর্কে আরেকটু বেশি কিছু জানার তৃষ্ণা পেয়েছে।

তবে সেই ১৯৪০ সালের আগেকার তথ্য সংগ্রহ করে লেখাটা মোটেও সহজ কাজ নয়। এর জন্য লেখক মিল্টন কুমার দেবকে বহু সময়, শ্রম ও মেধা খাটাতে হয়েছে তা বলার অবকাশ রাখে না। শেষটায় বলব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার যাত্রা ইতিহাসের পুরোটা যারা জানতে চান তাদের জন্য বইটি পড়া অপরিহার্য বলে মনে করি।

এ সম্পর্কিত আরো:
০১. ঢাবির প্রথম উপাচার্য হার্টগ বুঝেছিলেন বাঙালি সমাজে তদবির কী জিনিস!

০২. গৌরবের পথ চলায় ৯৯ বছরে পা দিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

​​​​​​০৩. ঢাবি ভিসি আখতারুজ্জামান: একজন ফুলব্রাইট স্কলারের গল্প

 

আরও পড়ুন আপনার মতামত লিখুন

© Copyright -Bangla Runner 2024 | All Right Reserved |

Design & Developed By Web Master Shawon